দিনে এখন শুধু মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কতো টাকার লেনদেন হয় খবর রাখেন – হাজার কোটি টাকার ওপরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, গেল শুধু মার্চেই মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে লেনদেন হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৭৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকারও বেশী। বছর শেষে এই অংক কিন্তু দেশের বাজেটের মোট অংককেও ছাপিয়ে যায়।
চোখ কপালে তোলার দরকার নেই। প্রতি মাসেই বাড়ছে লেনদেনের এই অংক। কিন্তু কেনো?
উত্তরটা প্রশ্নের মতোই সহজ। লেনদেনে এর চেয়ে সহজ পথ আর হয় কি করে! সুতরাং লেনদেনের কড়া সীমার নীচে থেকেও মানুষ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে, আর যার পথ ধরে লেনদেনটা সবার অলক্ষে বেড়েই চলেছে।
শুধুই যে সুবিধার তা কিন্তু নয়, আর্থিক খাতে প্রযুক্তির এই বিকাশ কখনো কখনো ঝুঁকিও নিয়ে আসে। এই যেমন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক বলতে গেলে বাধ্য হয়েই মোবাইল ফাইন্সিয়াল সেবার লাগাম টেনে ধরেছিল। কারণ, এক দিনে জঙ্গি অর্থায়ন; অন্যদিকে রেমিটেন্সে প্রেরণে এই প্রযুক্তি সুবিধার অপব্যবহার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার সিদ্ধান্ত ছিল উপায় অন্ততহীন। যদিও বাঁধা তৈরী করে নয় বরং প্রযুক্তি দিয়ে প্রযুক্তিকে পাহারা দেওয়ার মাধ্যমেই কেবল লেনদেনকে নিরাপদ করা যায় – বিষয়টি বুঝতে তাদের অনেক সময় লেগেছে।
প্রযুক্তির পাহারাদার বসেছে এখন লেনদেনের বিভিন্ন পর্যায়ে। আর সে কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনেদেনের পুরনো যে সীমা ছিল সেটাকে বলতে গেলে একরকম ফিরিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে একটু আগেও এগিয়েছে।
ধন্যবাদ বাংলাদেশ ব্যাংককে।
মে মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্তও যেখানে একটি নম্বরে দিনে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা ক্যাশ-ইন এবং ১০ হাজার টাকার বেশী ক্যাশ-আউট করা যেতো না সেটি বাড়িয়ে ৩০ হাজার এবং ২৫ হাজার করা হয়েছে।
মাসে সর্বোচ্চ ক্যাশ-ইন ও ক্যাশ-আউটের পরিমান বাঁধা ছিল এক লাখ এবং ৫০ হাজার টাকায়, সেটি এখন উঠে আসল দুই লাখ ও দেড় লাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলারটি জারি করেছে সে অনুসারে গ্রাহক চাইলে একটি অ্যাকাউন্টে দিনে পাঁচ বার করে ক্যাশ-ইন এবং ক্যাশ-আউট করতে পারবেন, যেটি এর আগে ছিল সর্বোচ্চ দুইবার।
আমার বিবেচনায় এটি আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি পর্যায়ের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা এসেছে এক অ্যাকাউন্ট থেকে আরেক অ্যাকাউন্টের লেনেদেনের ক্ষেত্রেও। ১৯ মে পর্যন্ত এক একাউন্ট থেকে দিনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার এবং মাসে ২৫ হাজার টাকার লেনদেন করা যেতো। যা এখন বাড়িয়ে দিনে ২৫ হাজার টাকা এবং মাসে ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে।
আমার বিবেচনায় স্বাধনীতার এই সুবিধা গ্রাহকরা আরো বেশী উপভোগ করবেন এবং মাসে ৩৪ হাজার কোটি টাকার লেনদেনকে মুহুর্তেই লাখ কোটি টাকায় নিয়ে যেতে একটুও সময় লাগবে না।
বলতে গেলে দেশের মানুষ কেবল বুঝতে শুরু করেছে, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে (সে হোক অ্যাপ ব্যবহার করে বা এইচএসডি কোড ব্যবহার) লেনদেনের মজাটা কোথায়। এখন সামনে কেবলই ছুটে চলার দিগন্ত প্রসারিত সম্ভাবণা।
দেখুন, ইউরোপে কার্ডের ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে কার্ডের যে ব্যবহার তাতে ১০ লাখের বেশী মানুষকে কার্ডে তোলা যায়নি। কিন্তু মাত্র সাত বছর আগে এমএফএস শুরু হয়ে এখন এর সংযোগ সংখ্যা সাড়ে ছয় কোটি। আর নিয়মিত ব্যবহার করছেন এমন সংযোগ আছে শোয়াতিন কোটির ওপরে।
ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তাছাড়া এমএফএস অপারেটররাও নানা সেবাকে তাদের নেটওয়ার্কে নিয়ে আসছে। ফলে দুয়ে মিলে যেটা হচ্ছে তা হল দেনদেনের কলেবর বড় থেকে বড় হচ্ছে। মানুষ আগের চেয়েও বেশী সেবা কিনতে পারেছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে।
এখানে অবশ্য একটি ডাক ও টেলিযোযোগ বিভাগের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি রাজনৈতিক চালও আছে। কিছুদিন আগে ডাক বিভাগের মাধ্যমে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নগদ নামে একটি আর্থিক সেবার প্রচালন করেছে। যেখানে দিনে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন করা যায়।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন ১৬টি লাইসেন্সির জন্যে এই সীমা ছিল মাত্র ১০ কি ১৫ হাজার টাকার। বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করেছিল ডাক বিভাগকে বাগে আনার। তারা যেহেতু সরকারের সঙ্গে পেরেওঠেনি তাই তারা এখন নানা যুক্তিকে লেনদেনের সীমা বাড়ানোর মাধ্যমে বিকাশ এবং অন্যান্যদের খানিকটা হলেও পুশিয়ে দিতে চাইলো।
যুক্তি বা তর্ক যেটাই হোক, সিদ্ধান্তটা যে খুবই ইতিবাচক হয়েছে সেটি বলতেই হবে।
এতোক্ষন যে বাংলাদেশ ব্যাংক ধন্যবাদ পেয়ে গদগদ হয়ে গেল, এখন তারা নিক না আরেকটা চ্যালেঞ্জ। এতো বছর হয়ে গেল এখনো এক অপারেটর থেকে আরেক অপারেটরে টাকা পাঠানো যায় না – যেটাকে বলা হয় ইন্টারঅপারেটিবিলিটি।
গত কয়েক বছর এই প্রশ্নের মুখে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা নানান কথা বলেন, বলতে গেলে কথার ছলচাতুরি করেন। কিন্তু এই কাজটা করেন না। ফলে যেটা হচ্ছে, দিনে দিনে বড় যে অপারেটর সেই বিকাশ আরো বিকশিত হচ্ছেন। আর অন্যরা আটকে থাকছেন।
পরিস্থিতিটা এমন যে গ্রামীণফোন দিয়ে কেবল গ্রামীণফোনেই কথা বলা যাবে বা রবি দিয়ে কেবল রবিতেই কথা যাবে – এমন যদি হতো তাহলে কি দাঁড়াতো পরিস্থিতি। সবাই কিন্তু রবি, বাংলালিংক বা টেলিটকে ভিড় করতো না। সবাই তখন গ্রামীণফোনেই চলে যেতো। কারণ তার নেটওয়ার্ক বড় এবং তার কাছেই অীধকাংশ মানুষ।
এখানেও বাংলাদেশ ব্যাংক বছরের পর বছর অপেক্ষা করে প্রকারন্তরে একজনকেই বড় হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে যাকে আমি বলবো অনৈতিক আচরণ।
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেনে আগের চেয়ে স্বাধীনতা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহককে এক অপারেটর থেকে আরেক অপারেটরে লেনদেনের স্বাধীনতাটাও বাংলাদেশ ব্যাংক দিলেই কেবল আর্থিক খাতের এই অংশটির ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত হবে।
সংবাদ নিয়ে আলোচনা